মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার...
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলিয়ে দিতে একটি মহল গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সোমবার বেলা ১১টায়...
সিলেট-৫
ফাইল ছবি
গত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৫ আসনে বিএনপি থেকে প্রাথমিক অবস্থায় দলের মনোনয়নপ্রাপ্ত হন সিলেট জেলা বিএনপির প্রথম সহ সভাপতি মামুনুর রশীদ (চাকসু মামুন)। পরে অবশ্য হাইকমান্ডের নির্দেশনায় জোটের স্বার্থে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর জোটের শরীক দলের প্রার্থী এখান থেকে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করেন। তিনি যখন দল থেকে মনোনয়নপ্রাপ্ত হন তখন দলের নেতাকর্মীরা হামলা-মামলায় বিপর্যস্ত ছিল। বলা যায় বিএনপির জন্য চরম দুর্দিন ছিল, এসময় ঝুঁকি নিয়ে দিশেহারা নেতাকর্মীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন চাকসু মামুন। জুলাই গণ অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলে বিএনপির জন্য সুদিন আসে। কিন্তু এই সময়ে এসে দলীয় মনোনয়ন পেতে ‘অনিশ্চয়তায়’ ভুগছেন চাকসু মামুন। এমনটা জানালেন তৃণমূলের কর্মীরা।
তবে আশাবাদী রয়েছেন মামুনুর রশীদ (চাকসু মামুন)। তিনি বলেন, প্রায় তিন মাস আগে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলীয় কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে অর্ধ ঘন্টার বেশি ফোনে কথা বলেছেন। এসময় তিনি আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা মোতাবেক নির্বাচনী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। একদিনের জন্যও কার্যক্রম বন্ধ রাখিনি। আমার বিশ^াস দল এ অঞ্চলের নেতাকর্মীর ত্যাগ ও আমার কাজের মূল্যায়ন করবে।
দলীয় সূত্র জানায়, সপ্তাহখানেক আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের ২৩৭টি আসনের একটি তালিকা ঘোষণা করেন। এ তালিকায় সিলেটের ৬টি আসনের মধ্যে ৪টি আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। আর বাকি দু’আসন সিলেট-৪ ও ৫ পরবর্তীতে ঘোষণা করা হবে বলে মহাসচিব জানান। এই অবস্থায় তিন দিনের মধ্যে কেন্দ্র থেকে সিলেট-৪ আসনের সিদ্ধান্ত আসে। এ আসনে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয় বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সাবেক সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নাম। ঝুলিয়ে রাখা হলো সিলেট-৫। এতে অনিশ্চয়তা ও হতাশায় ভুগছেন দলের নেতাকর্মীরা।
সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট নিয়ে সংসদীয় আসন সিলেট-৫ গঠিত। এ আসনে গত কয়েক বছর ধরে মাঠে অনেকটা একতরফা আলোচনায় ছিলেন সিলেট জেলা বিএনপির প্রথম সহ সভাপতি মামুনুর রশীদ (চাকসু মামুন)। তবে এখন ভোটের মাঠে তাঁকে ‘ঠেক্কা দিতে’ প্রচারণায় নেমেছেন বিএনপি-জামায়াত-জমিয়তের একাধিক নেতা। তাঁরা হলেন সিলেট জেলা বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আশিক উদ্দিন চৌধুরী, জামায়াতে ইসলাম সিলেট জেলার নায়েবে আমীর হাফিজ আনোয়ার হোসেন খান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক।
তাাঁরা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে আগ্রহী। এ কারণে তাঁরা এবং তাঁদের কর্মী-সমর্থকেরা নির্বাচনী এলাকায় তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে নানা ধরনের অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশ আয়োজনের মাধ্যমে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছেন।
এদিকে, চাকসু মামুনও দলের ৩১ দফা কর্মসূচিসহ স্থানীয় বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ভোটারের কাছে ছুটছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নদী ভাঙ্গন সহ এলাকার বিভিন্ন সমস্যার নিরসনের দাবিতে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মন জয়ের চেষ্টা করছেন। এছাড়া প্রতিদিন রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-তুফান উপেক্ষা করে প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও কর্মীসভা,উঠান বৈঠক,জনসভা ও বিভিন্ন পেশাজীবিদের সাথে মতবিনিময় করে যাচ্ছেন। গভীর রাত পর্যন্ত তিনি জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের গ্রামে গ্রামে উঠান বৈঠক ও গণ সংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। চাকসু মামুনের সমর্থকেরা বলছেন, মামুনুর রশীদ সৎ, দক্ষ, দায়িত্বশীল ও জনবান্ধব নেতা হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য।
এদিকে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় চাকসু মামুন ভোটের মাঠে প্রচারণায় রয়েছেন এমন দাবি চাকসু মামুনের অনুসারীদের।
সিলেট জেলা বিএনপির প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক হাজী শরীফুল হক ও যুক্তরাজ্য বিএনপির উপদেষ্ঠা অধ্যাপক জাকি মোস্তফা টুটুল বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে এ অঞ্চলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১১২টি মামলা হয়েছিল। এসব মামলা ও শাসক গোষ্ঠীর নির্যাতনে কর্মীরা যখন দিশেহারা, ঠিক তখনই পাশে দাঁড়িয়েছিলেন চাকসু মামুন। তিনি ঝুঁকি নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে জকিগঞ্জ-কানাইঘাটে বিএনপি সুসংগঠিত ও শক্তিশালী। দলের এমন পরীক্ষিত নেতাকে হাইকমান্ড অবশ্যই মূল্যায়ন করবে।
ঠিক একইভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জকিগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক ইসমাঈল হোসেন সেলিম। তারা বলেন, সিলেট-৫ আসনে বিএনপিকে শক্তিশালী করতে দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন চাকসু মামুন। এখন অনেকেই এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, স্বপ্ন দেখা ভালো। কিন্তু দলের দুঃসময়ে কর্মীরা তাদেরকে পাশে পায়নি। দল অবশ্যই চাকসু মামুনের ত্যাগের মূল্যায়ন করবে।
বিএনপির সূত্র জানায়, এ আসনে সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে বিএনপি প্রার্থী পেয়েছিল, এরপর আর ভাগ্যে জোটেনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সিলেট জেলা বিএনপির প্রথম সহ সভাপতি মামুনুর রশীদকে (চাকসু মামুন) দলীয়ভাবে মনোনয়ন দেওয়া হলেও জোটের সঙ্গে আসন ভাগ-বাটোয়ারায় তার কপাল পুড়েছিল। দলের সিদ্ধান্তে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। তখন হতাশ হয় তৃণমূলের কর্মীরা। কিন্তু এবার তারা কোনো ভাবেই ছাড় দিতে চাননা।
সূত্র আরও জানায়, এ আসন থেকে ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ও বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আবুল হারিছ চৌধুরী। এরপর আসনটিতে বিএনপির জনপ্রিয় কোন নেতা প্রার্থী হওয়ার সুযোগই পাননি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রয়ারীর নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন আব্দুল কাহির চৌধুরী। একই বছর ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে পদত্যাগ করে বিএনপি থেকে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন এম এ মতিন চৌধুরী। তবে তিনি ভোটের মাঠে ছিলেন নিষ্ক্রিয়। এরপর ৮ম ও ৯ম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির কাছ থেকে আসনটি বাগিয়ে নেয় জোটসঙ্গী জামায়াত। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের প্রার্থী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী। তিনি জোটের ভোটে বিজয়ী হয়ে সংসদে যান। ২০০৮ সালে আবারও জোটের প্রার্থী হলেও বিজয় ধরে রাখতে পারেননি তিনি। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হাফিজ আহমেদ মজুমদার ১,০৯,৬৯০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তখন তার নিকতম প্রতিদ্ব›িদ্ব বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থী জামায়াত নেতা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী ৭৮,০৬১ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক ৮,৯৪৬ ভোট পেয়েছিলেন।
এরপর একাদশ সংসদ নির্বাচনে ফের আসনটি জোটসঙ্গী জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে ছেড়ে দেয় বিএনপি। ওই নির্বাচনে বিএনপি জোটের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক। তিনি ধানের শীষ প্রতীকে মোট ভোট পেয়েছিলেন ৮৬ হাজার ১৫১ ভোট। আর নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাফিজ আহমদ মজুমদার ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৩৫ ভোট পেয়ে জয়ী হন। এটি ছিল ১৫৮টি কেন্দ্রের ফলাফল। শত প্রতিকূলতা ও রক্তপাতের মধ্যে মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এ ভোট পেয়েছিলেন।
কিন্তু এর আগে ২০০৮ সালে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের দলীয় প্রতীক নিয়ে মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক পেয়েছিলেন মাত্র ৮,৯৪৬ ভোট। এই দুই নির্বাচনের ভোটের হিসাব তুলনা করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এখানে বিএনপির অবস্থান খুবই শক্তিশালী রয়েছে।
এদিকে, বারবার জোটের শরীকদের আসনটি ছেড়ে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ রয়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। যার কারণে এবার নির্বাচনী জোটহলেও এ আসনটি ছাড়তে রাজি নন দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ও নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি হলো বার বার জোটের জন্য ছাড় দেওয়ায় দল ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
বিএনপিকে রক্ষা করতে দলীয় প্রার্থী দেওয়ার জোর দাবি জানান জকিগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান আহমদ ও কানাইঘাট উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক খসরুজ্জামান পারভেজ। তারা বলেন, আগামী নির্বাচনে আমরা প্রমাণ করবো জকিগঞ্জ-কানাইঘাট হলো বিএনপির দুর্গ।
কাওছার আহমদ