গুণী শিক্ষক ফণীভূষণ সরকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে আদর্শিক জীবনের বীজ বুনে দেন

post-title

ছবি সংগৃহীত

ফয়সল আহমদ রুহেল::  গুণী শিক্ষক ফণীভূষণ সরকার দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে জ্ঞান বিতরণ করেন শিক্ষার্থীরে মধ্যে। কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া মানুষ গড়ার কারিগর এই শিক্ষক জীবনমুখী শিক্ষা প্রদান করেন তাঁর কর্মজীবনে। তাঁর এই দীর্ঘ কর্মজীবনে শিক্ষার্থীদের সহজ থেকে কঠিনের দিকে, জানা থেকে অজানার দিকে, জ্ঞানের বিন্দু থেকে জ্ঞানসমুদ্রের দিকে নিয়ে যান। তিনি আবিদনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রায় ৩৫ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে চলে যান।

জন্ম : ফণীভূষণ সরকার ১৯৬৩ ইং সনের ১ নভেম্বর সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর উপজেলার ফারুকনগর এর সাড়ার কোনা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা গিরীন্দ্র সরকার ও মাতার লোবণ্য সরকার। এই শিক্ষক ৫ ভাই, ১ বোনের মধ্যে দ্বিতীয়।

শিক্ষাজীবন : গুণী শিক্ষক ফণীভূষণ সরকার গ্রামের স্কুলে-সাড়ার কোণা সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৭৯ সনে শিক্ষাজীবন শুরু করেন।  ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সনে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন।

এরপর ১৯৭৪ সনে মধ্যনগর বিপি উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু করেন। ১৯৮৩ সনে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগে তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন। ১৯৮৬ সনে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে চিওড়া ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিকে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। স্নাতক  ১৯৮৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মোহনগঞ্জ ডিগ্রী কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন। বি,এড ২০০০ সনে দ্বিতীয় বিভাগে সম্পন্ন করেন।

শিক্ষকতা জীবন :
ফণীভূষণ সরকার নতুন স্কুল নন এমপিও হাজী আব্দুল আহাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৮৯ সনে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন এক হাজার টাকা বেতনে। সরকারী বেতন না পাওয়ায় চাকরী ছেড়ে ১৯৯২ সনে নভেম্বর মাসে লজ্জাতুন নেছা উচ্চবিদ্যালয়, বিশ্বনাথ, সিলেট সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন। পারিবারিক সমস্যার কারণে বাড়ীর কাছে আবিদনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে ২০১০ ইং সনের ১ নভেম্বর যোগদান করেন এবং ২০২৩ ইং সনের নভেম্বর মাসে অবসর গ্রহণ করেন। প্রায় ৩৫ বছরে শিক্ষকতা জীবনের সমাপ্তি ঘটে।

শিক্ষা জীবনের স্মরণীয় ঘটনা :  ফণীভূষণ সরকারের শিক্ষা জীবনের অনেক স্মরণীয় ঘটনা ছিল। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য একটি স্মরণীয় ঘটনা তুলে ধরেন। প্রাইমারী স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে যখন পড়ি অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। স্যার যখন খাতা দিয়ে গেলে প্রশ্ন হাতে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখি লিখতে পারবনা, কিছুই জানিনা। তাই পরীক্ষার খাতায় বড় বড় অক্ষরে লিখলাম-সমাজ বিজ্ঞান আমাদের পড়া হয় নাই তাই লিখতে পারলাম না" দুঃখিত স্যার ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু স্যার ক্ষমা করলেন না, স্কুল ছুটির পর আমাকে বাড়ী থেকে ডাকিয়ে স্কুলে নিলেন, আমি ভয়ে ভয়ে স্যারে কাছে গেলাম- স্যার বললেন এটা কি লেখেছ- কোন উত্তর নাই স্যার রেগে গিয়ে আমার গালে টাস করে একটি থাপ্পর বসিয়ে দিলেন আর বললেন পড়া হয়নি তা কি হয়েছে তুইতো ভাল ছাত্র যা কিছু জানা আছে তাতো লিখতে পারতে।

শিক্ষকতা জীবনের স্মরণীর ঘটনা : শ্রদ্ধেয় ফণীভূষণ সরকার শিক্ষকতা জীবনের স্মরনীয় ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা তাঁকে এখনও পীড়া দেয়। সে ঘটনা তুলে ধরেন। সালটা মনে নেই প্রতি বছরেই স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া হয় এ বছরে হবে। বার্ষিক ক্রীড়া পূর্ব দিন মিটিং হল স্থারীয় এমপি মহোদয় প্রধান অতিথি সিদ্ধান্ত হল ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করা এবং আপ্যায়নের কিছু ফলফ্রুট। আমার উপর দায়িত্ব পরল শহরে গিয়ে ফুলের তোরা নিয়ে আসতে পরের দিন সকালে একটা অটো নিয়ে শহরে যাই- ফুল নিয়ে ৯টা সাড়ে ৯টার মধ্যে স্কুলে এসে দেখতে পাই শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রীদের এক জায়গায় জটলা হয়ে আছে ফুলের তোড়া রেখে ভিড় ঢেলে ভিতরে যাই দেখতে পাই স্কুলের সভাপতি মহাশয়ের হাতে একটি বেত দিয়ে একটা ছাত্রকে পিটাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে কোন উত্তর নাই ছেলেটা আমাকে দেখে হাউমাউ করে করে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল স্যার আমি কিছুই করি নাই আমাকে মারছে। এ দৃশ্য দেখে আমি ঠিক থাকতে পারি নাই। আমার মাথা গরম হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে সভাপতি হাত থেকে বেতটা কেড়ে নিয়ে বললাম আপনি শাসন করার কে? ছাত্র যদি দোষ করেই থাকে শাসন করবে শিক্ষক আপনি তো শাসন করতে পারেন না। আমার এহেন আচরন দেখে সবাই অবাক হয়ে গেছে, অনেকেই বলতে লাগল এবার চাকরীটা গেছে। তারপর সবাই যার যার স্থানে চলে গেলাম। সারাদিন হইহুল্লা করে বার্ষিক ক্রীড়া শেষ হল। আমার মধ্যে একটা ভয় কাজ করছে সত্যি সত্যি আমার চাকরী চলে যাবে, তবে মনে সান্তনা এটাই আমি অন্যায় কিছু করি নাই। যদি চলে যায় তো যাবেই। রাতেই শুনতে পেলাম পিয়ন এসে বলে গেল আগামী দিন স্কুলে জরুরী মিটিং সকল শিক্ষক ও পরিচালনা পরিষদের সদস্য বৃন্দকে উপস্থিত থাকার জন্য। পরের দিন স্কুলে যাই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় আমার এহেন আচরনের জন্য সময়িক বরখাস্ত। মাথা নিচু করে মনে দুঃখ নিয়ে লজিং বাড়িতে ফিরি। সন্ধ্যার পড়েই আমার প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রছাত্রী বর্তমান ছাত্র ছাত্রী লজিং বাড়ীর ওঠান ভরে যায়। আমি ঘর থেকে শুনতে পাই আমাদের স্যারের এহেস অপমানের জবাব আমরা নেবই। আমি ঘর থেকে বাহির হয়ে তাদের বোঝালাম আমার যা হবার তাতো হয়ে গেছে তোমরা এনিয়ে বাড়াবাড়ি করনা।  ছাত্রছাত্রীর আমার কথা মানল না পরের দিন স্কুল শুরু হতেই শুনতে পাই ছাত্রছাত্রীর স্কুলে তালা লাগিয়ে দিয়েছে আর সভাপতির বিরুদ্ধে মিছিল করছে। বিকাল ২টায় পিয়ন এসে বলল স্যার আপনাকে স্কুলে যেতে হবে সভাপতি ও অন্যান্য সদস্যবৃন্দ আপনাকে ডাকছে।  স্কুলে গেলাম ছাত্ররা আমাকে দেখে আরও জোরে জোরে মিছিল করতে লাগল তাদের কোন প্রকারে শান্ত করে স্কুলে ঢুকি। ঢোকা মাত্রই সভাপতি বলে উঠলো আপনি তো বিরাট পর নেতা, শিক্ষকতা ছেড়ে আপনি এমপিতে দাঁড়ান পাশ করতে পারবে, কথা শুনে ভয় পেলাম। তার পরক্ষনেই বললেন আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে নেওয়া হল কাল থেকে স্কুলে আসবে।

পারিবারিক : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ফণীভূষণ সরকার দুই সন্তানের জনক। প্রথম ছেলে-রুদ্র সরকার, সিলেট এসসি কলেজে মাষ্টার পড়ে আর ২য় ছেলে ৫ম পর্যন্ত পড়ে শারীরিক অসুস্থতার জন্য আর পড়তে পারে নাই, বাড়ীতে আছে।

২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুণী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় মধ্যনগর উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার ২৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।

উল্লেখ্য, ২৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।

শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ফণীভূষণ দীর্ঘ জীবনে মেধা, মনন, শ্রম ও ভালোবাসায় সমাজ আলোকিত করেন। তাঁর দীক্ষায় বেড়ে ওঠে মননশীল প্রজন্ম। প্রায় ৩৫ বছর শিক্ষকতা জীবনে তিনি মেধা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা কিংবা আদর্শিক জীবনের বীজ বুনে দেন। এই শিক্ষকের সুস্থ ও দীর্ঘায়ূ কামনা করি।

এসএ/সিলেট